চীনে দ্রুত হ্রাস হচ্ছে প্রজনন হার, ব্যাপক শঙ্কা

বড় দুটি সমস্যার মধ্য দিয়ে পার হয়ে চীনের দিনগুলো। প্রথম সমস্যা বিয়ের হার হ্রাস, পাশাপাশি মানুষের প্রজনন হার (ফার্টিলিটি রেট) কমে যাওয়া। দেশটির ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মানুষ এ সমস্যার সম্মুখীন। যে কারণে বয়স্কদের হার বেড়ে যাচ্ছে দেশটিতে। চীনের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী দেশটিতে বিবাহিত লোকের সংখ্যা প্রথমবারের মতো ৪১ শতাংশ কমে ২০১৯ সালে ২৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন থেকে ১৩ দশমিক ৯ মিলিয়নে নেমে গেছে।

চীনা গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত সরকারি উপাত্তে দেখা গেছে হাজার হাজার চীনা নাগরিক তাদের বিয়ে স্থগিত করে রেখেছে অথবা বিয়ে থেকে একেবারে বিরত রয়েছে। নব্বইয়ের দশকে চীনের জনসংখ্যার মধ্যে প্রজনন হার কমে মাত্র ১ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে, যার সূত্র ধরে দেশটিতে বয়স্ক জনসংখ্যার হারও বেড়ে যায়। ফার্টিলিটির হার তুলনামূলক হ্রাস না পেলেও তা বার্ধক্যের হার বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।

২০১৬ সাল পর্যন্ত চীনে এক-সন্তান নীতি চলছিল। পরে সেটি বেড়ে দুই শিশুতে চলে আসে। চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস জানায়, এক থেকে দুই শিশু নীতি যাওয়ায় দেশে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা কিছুটা বেড়ে ১ দশমিক ৫৮ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে, বর্তমানে দেশটিতে ফার্টিলিটির হার আবার কমতে শুরু করেছে।

২০১৮ সালে ফার্টিলিটির হার ছিল ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বর্তমান চীনের জনগণের মধ্যে ফার্টিলিটি যে হারে কমছে সে অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে তা নব্বইয়ের দশকের সমপর্যায়ে নেমে আসবে। চীন সরকারের জন্য এটি রীতিমতো আশঙ্কার বিষয়।

১৯৭৩ সালে চীন ‘দেরিতে বিয়ে, দীর্ঘ ব্যবধান এবং কম সন্তান’ প্রচারনা শুরু করে। এতে চীনা নারীদের বিশেষ করে দুটির বেশি সন্তান গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হয়। ১৯৭৮ সালে দেশটিতে এক-সন্তান নীতি চালু করা হয়। ফলস্বরূপ দেশটিতে ফার্টিলিটি হারও কমতে থাকে। আশির দশকের মধ্যবর্তী সময়ে এটি ২ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসে, যা ষাট এবং সত্তরের দশকে ছিল ছয় শতাংশ।

২০১৬ সালে এক-সন্তান নীতি শিথিল করা সত্ত্বেও প্রতি হাজার দম্পতির জীবিত শিশু জন্মদানের হার কমে রেকর্ড ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়ায়। বর্তমানের এই ধারা অব্যাহত থাকলে জনসংখ্যা হ্রাসপাবে এবং অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয় কমে যাবে। আর ভোগব্যয় কমে যাওয়ার নিশ্চিত ফলাফল শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।

গত দশকে চীনে বছরে এক কোটি ৮০ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে, যেখানে এ হার সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল আড়াই থেকে তিন কোটি। ২০১৯ সালে চীনে মাত্র এক কোটি ৪৬ লাখ ৫০ হাজার সদ্যজাত শিশুর নাম নিবন্ধন করা হয়। গত বছর এই সংখ্যা প্রায় ১৫ শতাংশ কমে এক কোটি ৩০ হাজারে পৌঁছে। অবশ্য গত বছর করোনাভাইরাস মহামারির কারণেও দেশটিতে জন্মহার অনেক কমেছে।

দেশটিতে দ্রুত ও টেকসই শহরায়ন, সর্বজনীন শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নও দেশটিতে ফার্টিলিটির হার কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। সাধারণ মানুষের মধ্যে উর্বরতা বা ফার্টিলিটির হার কমে গেলে নানা রকম ঝুঁকি তৈরি হয়। বার্ধক্য জনসংখ্যা হ্রাস দিয়ে এসব ঝুঁকির শুরু হয়। এ ছাড়া কমে যায় কর্মক্ষম জনসংখ্যাও। গত দশকে চীনে কর্মক্ষম বয়সী জনসংখ্যা বছরে কমেছে ৩৪ লাখ করে। বর্তমানে যেসব চীনা নাগরিক কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছেন তাদের বেশিরভাগেরই জন্ম যখন মানুষের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা মাত্র কমতে শুরু করেছিল।

চীনে জন্মহার কমলেও বাড়ছে আয়ুষ্কাল। ফলে দেখা যাচ্ছে দেশটিতে ৬০ বছর বয়সী বয়স্ক জনসংখ্যার হার বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে চীনে ১৫ বছর ও এর কম বয়সী শিশুদের তুলনায় বয়স্কলোকের সংখ্যা বেশি। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশটিতে বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা ২৫ কোটি ৪০ লাখ থেকে বেড়ে ৫০ কোটিতে পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ধারাগুলো চীনের অর্থনৈতিক গতিপথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। শ্রমশক্তিতে তরুণদের অংশগ্রহণের হার কমে যাবে। বয়স্কদের পেনশন এবং সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার পরিমাণ সংগৃহীত কর রাজস্বকেও ছাড়িয়ে যাবে; আর এর চূড়ান্ত চাপ পড়বে সরকারের বাজেটের ওপর।