সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার খলসি গ্রামে একই পরিবারের চারজনকে গলা কেটে হত্যার ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেছে সিআইডি পুলিশ। হত্যায় জড়িত নিহত শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম।
পারিবারিক বিরোধের জেরেই পরিকল্পিতভাবে বড় ভাই, ভাবিসহ ভাতিজা-ভাতিজিকে হত্যা করা হয়। উদ্ধার করা হয় হত্যায় ব্যবহৃত চাপাতি। জিজ্ঞাসাবাদে রায়হানুল জানিয়েছে, শয়তান আমার ওপর ভর করেছিল, তাই আমি এটা করেছি।
বুধবার বিকেল ৫টায় হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন নিয়ে সিআইডি সাতক্ষীরা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সিআইডির খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক।
তিনি জানান, সন্দেহজনক হিসেবে নিহত শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই রায়হানুলকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে তার দোষ স্বীকার করে ও ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছে। মূলত ভাই ও ভাবির সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরেই এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম কোনো কাজ করতো না। তার কোনো রোজগার ছিল না। ৯-১০ মাস আগে তার স্ত্রীও চলে যায়। এরপর থেকে বড় ভাই শাহিনুর রহমানের সংসারেই সে খাওয়া দাওয়া করতো। এটা নিয়ে ভাই-ভাবি মাঝে মাঝে বকা দিতো। ১৪ অক্টোবর বুধবার ভাবি তাকে গালমন্দ করে। কাজ করে না শুধু খায়, এ কথা বলে ভাবি। এগুলো বলার পর সে তার ভাবিকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক জানান, ওইদিন সন্ধ্যায় পার্শ্ববর্তী দোকান থেকে দুটো ঘুমের ওষুধ ও দুটো কোমলপানীয় (স্পিড) কেনে। বাড়ি ফিরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে একটি কোমল পানীয়র মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ভাবি ও ভাইপো-ভাইজিকে খেতে দেয়। রাত দেড়টার দিকে বড় ভাই শাহিনুর রহমান মাছের ঘের থেকে বাড়ি আসে। তখন রায়হানুল টিভি দেখছিল। তখন সে রায়হানুলকে খুব বকাবকি করে। ভাই বলে, তুই বিদ্যুৎ বিল দিতে পারিস না, টিভি দেখিস কেন। তখন তার কাছে থাকা আরেকটি কোমলপানীয়র মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ভাইকে খেতে দেয়।
এ সময় রায়হানুল বলে, তুমি মাথা ঠান্ডা করো, এটা খাও। এ মাসের বিদ্যুৎ বিল আমি দেব। তখন তার ভাই শাহিনুর রহমান সেটি খায়।
তিনি জানান, রাত ৩-৪টার দিকে একটি তাওয়াল নিয়ে খালি গায়ে বাড়ির ছাদ দিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে রায়হানুল। বড় ভাই শাহিনুর রহমানকে ঘুমন্ত অবস্থায় চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। এরপর গামছা দিয়ে গলায় চেপে ধরে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ভাইয়ের হাতের রগ কেটে দেয় ও পা বেঁধে রাখে। এরপর ভাবির ঘরে প্রবেশ করে ভাবিকে কোপ দেয়। ভাবিকে কোপ দেয়ার পর ভাবি চিৎকার দিলে ছেলে-মেয়ে জেগে যায়। তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাবির সঙ্গে দুই সন্তানকেও হত্যা করে।
জিজ্ঞাসবাদে রায়হানুল ইসলাম আর জানিয়েছে, ঘটনার সময় তার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তার বক্তব্য, শয়তান আমার ওপর ভর করেছে তাই আমি এটা করেছি। এরপর হত্যার কাজে ব্যবহৃত চাপাতি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। এছাড়া তাওয়ালটি রায়হানুলের ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সে জানিয়েছে, এ ঘটনায় সে একাই জড়িত।
হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনায় মঙ্গলবার উপজেলার আব্দুস সামাদের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (২৮), আবুল কাশেমের ছেলে আব্দুল মালেক (৩৫) ও আসাদুল ইসলামকে (২৭) গ্রেফতার করেছে সিআইডি। রাজ্জাক ও মালেক নিহত শাহিনুর রহমানের প্রতিবেশী ও আসাদুল ইসলাম নিহত শাহিনুরের হ্যাচারির কর্মচারী। তাদের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেফতার অন্যদের বিষয়ে সিআইডি কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, তদন্ত চলছে। যদিও বর্তমান পর্যন্ত তাদের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ বা আলামত মেলেনি। ঘটনায় একজনই জড়িত। প্রয়োজন না হলে তাদের রিমান্ডে আনা হবে না।
প্রসঙ্গত, ১৫ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) ভোররাতে খলসি গ্রামের শাহাজান আলীর ছেলে মাছের ঘের ব্যবসায়ী শাহিনুর রহমান (৪০), তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন (৩০), ছেলে সিয়াম হোসেন মাহি (৯) ও মেয়ে তাসনিমকে (৬) ঘরের মধ্যে জবাই করে হত্যা করা হয়।
ছয় মাস বয়সী অপর শিশু মারিয়া সুলতানাকে হত্যা না করে মায়ের লাশের পাশে ফেলে রাখা হয়। এ ঘটনায় নিহত শাহিনুর রহমানের শাশুড়ি ময়না বেগম ওইদিন রাতেই অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে কলারোয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করে। মামলাটির তদন্তভার নেয় সাতক্ষীরা সিআইডি পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এ হত্যার ঘটনার সাতদিনের মাথায় হত্যার রহস্য উন্মোচন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলো সিআইডি পুলিশ।