যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র দুদিন বাকি। এরই মধ্যে ৯ কোটি ভোটার আগাম ভোট দিয়ে ফেলেছেন। নির্বাচন নিয়ে দেশজুড়ে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা।
নির্বাচনের দিন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। নিউইয়র্কসহ অন্যান্য শহরের ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে সেনাও মোতায়েন করা হতে পারে।
এবারের নির্বাচনে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ৪৩ শতাংশ ভোটার আগাম ভোট দেওয়ায় আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে অর্ধেকের বেশি ভোট পড়েছে ব্যালটবাক্সে, যা ২০১৬ সালের নির্বাচনের মোট ভোটের দু-তৃতীয়াংশ।
শেষ মুহূর্তে প্রার্থীরা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন এক অঙ্গরাজ্য থেকে আরেক অঙ্গরাজ্যে। বিশেষ করে সুইং স্টেটগুলোর ইলেকটোরাল ভোটগুলোই তাঁদের লক্ষ্য।
স্থানীয় সময় গতকাল শনিবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেনসিলভানিয়ায় চারটি সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন। অন্যদিকে, জো বাইডেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে মিশিগানের ফ্লিন্ট সিটিতে প্রথমবারের মতো যৌথভাবে একই সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন। ওবামা এ অঙ্গরাজ্যে দুবারই জয় পেয়েছিলেন। পরে তাঁরা ডেট্রয়েটের বিভিন্ন সমাবেশে অংশ নেন। নির্বাচনের আগের দিন সোমবার ওবামা সাউথ ফ্লোরিডা ও আটলান্টায় বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেবেন। এরই মধ্যে শনিবার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ফ্লোরিডায় বিভিন্ন সমাবেশ ও র্যালিতে অংশ নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ গণমাধ্যম সিএনএন সর্বশেষ নির্বাচনী জরিপে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী জো বাইডেনকেই এগিয়ে রেখেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে তিনি ১২ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন। আগাম ভোট দেওয়া ব্যক্তিদের ৬৪ শতাংশ এবং নারী ভোটারদের মধ্যে ৬১ শতাংশ বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন। শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের ক্ষেত্রে ব্যবধান অনেকটা কমিয়ে এনেছেন বাইডেন। সর্বশেষ এই জরিপে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের ৫০ ভাগ পড়েছে ট্রাম্পের পক্ষে আর ৪৮ ভাগ ভোটার বেছে নিয়েছেন বাইডেনকে। এক সপ্তাহ আগেও এই ব্যবধান ছিল ৬ পয়েন্টেরও বেশি।
শেষ মুহূর্তে দুই প্রার্থীই জিততে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন তাঁরা তিন থেকে পাঁচটি অঙ্গরাজ্য সফর করছেন। জিততে হলে মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন ও ফ্লোরিডায় জয়ের কোনো বিকল্প নেই ট্রাম্পের। ২০১৬ সালেও তিনি এই চারটি অঙ্গরাজ্যে চমক দেখিয়েছিলেন। বিশেষ করে ফ্লোরিডা তাঁর প্রধান লক্ষ্য। আর এ জন্য নিউইয়র্কের পরিবর্তে এবার ফ্লোরিডায় আগাম ভোট দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া ডেমোক্রেটদের দুর্গ বলে পরিচিত অ্যারিজোনা ও জর্জিয়াতেও হানা দিতে চান ট্রাম্প।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব অঙ্গরাজ্যে কয়েক দশক ধরে ডেমোক্রেটদের আধিপত্যই বেশি। এ ছাড়া রিপাবলিকানদের অন্যতম প্রধান দুর্গ টেক্সাসে এবার আধিপত্য বিস্তার করেছেন ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন। আর এটাই কপালে ভাঁজ ফেলেছে ট্রাম্পশিবিরে। অন্যদিকে সুইং স্টেট পেনসিলভানিয়ায় দিন দিন বাইডেনের পক্ষে ভোট বেশি পড়ছে। গত নির্বাচনে সেখানে ট্রাম্পের কাছে খুব অল্প ব্যবধানে হেরেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এবার অনেক বেশি ব্যবধানে সেখানে ট্রাম্পের পরাজয় হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকেই। ২০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের এই অঙ্গরাজ্যটি বাইডেনের জয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও উত্তেজনা বিরাজ করছে। এবারের নির্বাচনী প্রচারে বাংলাদেশিদের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সমর্থকরা সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। প্রচার চালাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়েও পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাচ্ছেন তাঁরা।
ডেমোক্রেটিক দলের সমর্থকরা বলছেন, জো বাইডেন ইজ দ্য বেস্ট। অভিবাসনবান্ধব বাইডেন বিজয়ী হলে তিনি নতুন এক যুক্তরাষ্ট্র উপহার দেবেন। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক মন্দা আর ট্রাম্পের নানা দুর্নীতি ভোটারদের কাছে তুলে ধরছেন তাঁরা।
আর রিপাবলিকানরা বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইজ আ গ্রেট প্রেসিডেন্ট। দেশপ্রেমিক ট্রাম্প বিজয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
বাংলাদেশি-আমেরিকান রিপাবলিকান অ্যালায়েন্সের চেয়ারম্যান নাসির খান পল জানিয়েছেন, দেশব্যাপী কোনো জরিপ নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। ট্রাম্পকে গ্রেট প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করে তিনি জানান, ৩ নভেম্বর ভোটের দিনই ট্রাম্পের নীরব সমর্থকরা ভোট দেবেন। তাই এখনকার জরিপ কোনো কাজে আসবে না। আর প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যে তিন-চারটি সুইং স্টেটে জয় প্রয়োজন, সেখানে অনেক বেশি ব্যবধানে জিতবেন ট্রাম্প।
সাউথ আলাবামা ইউনিভার্সিটির ডিজিটাল জার্নালিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড: এম দেলোয়ার হোসাইন জানিয়েছেন, গত চার বছর অনেক কিছুতেই ব্যর্থ হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মোকাবিলা, অর্থনৈতিক মন্দা এবং ব্যক্তিগত ট্যাক্স ফাঁকির বদনাম এবারের নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। আর এসব কারণে অনেক সমর্থক তাঁর পাশ থেকে সরে গেছেন। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন এবার তাঁর পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই আন্দোলনে শ্বেতাঙ্গরাও অংশ নিয়েছেন।
ড: দেলোয়ার হোসাইন আরো জানান, নির্বাচনের দিন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সহিংসতা বাড়তে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জো বাইডেন ক্লিন ইমেজের কারণে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক ব্যর্থতার অভিযোগ মাথায় নিয়েও আবারও চমক দেখাতে পারেন।
জটিল সমীকরণের এই নির্বাচনে কে বিজয়ী হবেন, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৩ নভেম্বর ভোটের দিন পর্যন্ত।