১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর একদল বিপদগামী সেনাসদস্য জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলা জেলহত্যা মামলা হিসেবে পরিচিত। ঘটনার ৪৫ বছরেও রায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
এ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ১৫ আসামির মধ্যে মাত্র পাঁচজনকে ধরতে পেরেছে পুলিশ। যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ওই আসামিরা হলেন সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ও আবদুল মাজেদ। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় তাদের সবাইকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। জেলহত্যা মামলায় বাকি ১০ আসামি এখনো অধরা। হত্যাকাণ্ডের ৪৫ বছরেও তাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি।
পলাতক ফাঁসির তিন আসামি হলেন এলডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধা, দফাদার মারফত আলী শাহ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিরা হলেন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আহমেদ শরিফুল হোসেন, কিসমত হাসেম ও নাজমুল হোসেন। এই পলাতক আসামিদের মধ্যে তিনজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও সাতজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করতে একটি টাস্কফোর্স কাজ করছে।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান রায় দেন।
রায়ে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি হলেন রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধা। আর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১২ জন হলেন সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আবদুল মাজেদ, আহমদ শরিফুল হোসেন, কিসমত হোসেন ও নাজমুল হোসেন।
এরপর তিনজনের ফাঁসির রায় অনুমোদনের জন্য নিম্ন আদালত থেকে পাঠানো ডেথ রেফারেন্স এবং কারাবন্দি আসামিদের করা আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট রায় দেন। রায়ে ৯ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। আর ছয়জনকে খালাস দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের রায়ে মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি দুই আসামি মারফত আলী শাহ ও আবুল হাসেম মৃধাকে খালাস দেওয়া হয়। এ ছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ফারুক রহমান, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে খালাস দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আপিল করার অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) আবেদন করে সরকার।
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় চারজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় ওই চারজনকে বাদ দিয়ে অন্যদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় আপিল বিভাগে। এ অবস্থায় আপিল বিভাগ ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি এক আদেশে মারফত আলী শাহ ও আবুল হাসেম মৃধাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। আত্মসমর্পণ না করলে তাঁদেরকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন পর ২০১৩ সালে আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। আসামিরা পলাতক থাকায় আপিল বিভাগে তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিল না। এ কারণে দুই আসামির পক্ষে শুনানি করতে ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর শুনানি শেষে তখনকার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ওই বছরের ৩০ এপ্রিল রায় দেন।
রায়ে দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে হাইকার্টে দেওয়া ৯ জনের সাজাও বহাল রাখা হয়। এরইমধ্যে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফলে জেলহত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি এবং যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সাত আসামি এখন পর্যন্ত অধরা।